শুক্রবার, ৫ জুন, ২০১৫

পারমাণবিক অস্ত্র

বিজ্ঞানের এক ভয়াবহ
আবিষ্কারঃ পারমাণবিক অস্ত্র
বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার যে সবসময়
মানুষের কল্যাণে এসেছে এমনটা নয়।
বিজ্ঞান আমাদের হাতে এমন কিছু
আবিষ্কারও তুলে দিয়েছে যা আমাদের
নিজেদেরই ধসের কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। হয়তো সেগুলো কারো
জন্য সফলতা বয়ে আনলেও অন্যদের
জন্য হয়েছে চরম ভয়াবহ। যদি প্রশ্ন ওঠে
যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক অস্ত্র কি?
তাহলে যে অস্ত্রের নাম আপনার মাথায়
সবার আগে আসবে সেটা হলো
পারমাণবিক অস্ত্র। কারণ এখন পর্যন্ত যে
অস্ত্রের ধবংসযজ্ঞ আমাদের মনে
সবচেয়ে বেশি ভয় জাগিয়েছিল সেটি
হলো পারমাণবিক অস্ত্র।
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি এখনও এক
জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে রয়েছে পারমাণবিক
অস্ত্রের ভয়াবহতার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
সেই দুটি পারমাণবিক বোমার কথা কখনোই
ভুলতে পারবে না মানব জাতি ৬ই
আগস্ট,১৯৪৫ সালে ইউরেনিয়াম দিয়ে  তৈরি
করা হয় লিটল বয় (বামন আকৃতির জন্য এর নাম
রাখা হয় লিটল বয়।) এর তিনদিন পরই ৯ই আগস্ট
যুক্তরাষ্ট্র আবার পারমাণবিক হামলা চালায়
নাগাসাকিতে। এবারের বোমটা ছিল
প্লুটোনিয়ামের তৈরি যার মোটা আকৃতির
জন্য নাম রাখা হয়েছিল ‘ফ্যাট ম্যান’। প্রচণ্ড
বিস্ফোরণ ও ক্ষতিকর আলোক-
কণাবিকিরণের কারণে তাৎক্ষণিক মারাগিয়েছিল
প্রায় ১,২০,০০০ মানুষ এবং আয়োনাইজিংয়ের
ফলে ধীরে ধীরে আরও অসংখ্য মানুষ
মারা গিয়েছিল।এবোমার বিস্ফোরণ এবং
কোনো দেশের অস্ত্রভাণ্ডারে এই
বোমার সংরক্ষণ খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়।
যদিও ইতিহাসবিদেরা মনে করেন যে
যুক্তরাষ্ট্রের জয় নিশ্চিত থাকা সত্ত্বেও
শুধুমাত্র তাদের অস্ত্রের ক্ষমতা
সম্পর্কে জানতে এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের
জন্যই পারমাণবিক হামলা চালানো হয়েছিল। যাই
হোক, বর্তমানে জাতিসংঘের পারমাণবিক
শক্তি চুক্তি অনুসারে পারমানবিক অস্ত্রের
উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করার কথা জানানো
হয়েছে। যদিও জানা যায় হিরোশিমা ও
নাগাসাকির সেই বিস্ফোরণের পরও এখন
পর্যন্ত আরও পাঁচশতাধিক বার
পরীক্ষামূলকভাবে এবং প্রদর্শনের জন্য
বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
বর্তমানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ
ঘটিয়েছে এবং মজুদ রয়েছে এমন
দেশগুলো
হলো যুক্তরাষ্ট্র , রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চী
এছাড়া এটা ব্যাপক ভাবে বিশ্বাস করা হয়
যে উত্তরকোরিয়া, ইরান,
ইসরাইলেওপারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।যে
পরিমাণ অস্ত্রের মজুদ এখনো
পৃথিবীতে রয়েছে তাতে মনে করা হয়
সে সকল পারমাণবিক অস্ত্র কাজে লাগিয়ে
কয়েকবার আমাদের এই পৃথিবী পুরোপুরি
ধংস করা সম্ভব।
বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার
লক্ষ্যে বিভিন্নদেশ ও সংগঠন এখন বেশ
তৎপর হচ্ছে।কিন্তু তার সুফল শীঘ্রই
পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিছুদিন
আগে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে
এই কথাই বলা হয়েছে।এতে উল্লেখ করা
হয়, বিশ্বজুড়ে এখনো ৫ হাজারেরও বেশি
পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে।এছাড়া
পরমাণুশক্তি ধরদেশগুলো অস্ত্র পদ্ধতি
নিয়ে নিত্যনতুন গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল
পিস রিসার্চইন্সটিটিউট (সিপরি)
এররিপোর্টেবলাহয়-
 যেকোনোমুহূর্তে ব্যবহারের জন্য
বিশ্বজুড়ে ৫ হাজারের ও বেশি পরমাণু
অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে। এগুলোর
মাঝে ২ হাজার অস্ত্র সর্বোচ্চ
সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।
রিপোর্টে আর ও বলা
হয় ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, ভারত,ইসরাইল, পাকিস্তান
বিশ্বের এ আটটি দেশ ২০ হাজার ৫০০ এর
বেশি এরূপ বোমারমালিক।এর মাঝে ২০১১
সালের জানুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়ার বোমার
পরিমাণ ১১ হাজার এবং মোতায়েন রয়েছে
২হাজার ৪২৭টি। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৮
হাজার ৫০০টি বোমা এবং মোতায়েনের
পরিমাণ ২ হাজার ১৫০টি।রিপোর্টেবলাহয়-
পরমাণুশক্তিধর এই আটটি দেশ তাদের
পরমাণু কর্মসূচি আরও উন্নত কিংবা অব্যাহত
রাখার বিষয়েও বেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। ফলে
নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বে অর্থপূর্ণ
নিরস্ত্রীকরণ ঘটার কোনো সম্ভাবনা
নেই।
বর্তমানে এই আটটি দেশ বাদেও যেসব
দেশকে সন্দেহ করা হচ্ছে যে তাদের
কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে অথবা
তারা পারমানবিক অস্ত্র নির্মাণের চেষ্টা
চালাচ্ছে সেই দেশটি হলো ইরান। কিছুদিন
পরেই আমাদের দেশেও আসতে
যাচ্ছে পারমাণবিক চুল্লী যার থেকে
আমরা পারমাণবিক শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ
উৎপাদন করবো। আমাদের মতো একটি
ঘন বসতিপূর্ণ দেশে এটা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ
এবং এটা থেকে কখনো আমাদের
দেশে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব কি
না, কীভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা হয়
এবং কীভাবে এগুলো কাজ করে
আলোচনা করবো এখানে। এছাড়াও বিশ্বে
যেসব দেশে এখনও পারমাণবিক বোমার
মজুদ আছে তাদের নিয়েও জানার চেষ্টা
করব।
সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের
আগে জানতে হবে পারমাণবিক অস্ত্র কী
এবং এটা কিভাবে বিস্ফোরিত হয়।
পারমাণবিক অস্ত্র, তা আবার কি?
পারমাণবিক অস্ত্র এমন এক ধরনের যন্ত্র যা
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে প্রাপ্ত প্রচণ্ড
শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক
ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে। সেই নিউক্লিয়ার
বিক্রিয়া ফিশানের ফলে অথবা ফিশান ও ফিউশান
উভয়ের সংমিশ্রণেওসংগঠিত হতে পারে।
উভয় বিক্রিয়ার কারণেই খুব অল্প পরিমাণ
পদার্থ থেকে বিশাল পরিমাণে শক্তি নির্গত
হয়। আধুনিক এক হাজার কিলোগ্রামের একটি
থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিস্ফোরণ
ক্ষমতা প্রচলিত প্রায় ১ বিলিয়ন
কিলোগ্রামের বিস্ফোরক দ্রব্যের
চেয়েও বেশি। এভাবেই শুধুমাত্র প্রচলিত
বোমার সমান আকারের একটি পারমাণবিক
বোমা দ্বারাই একটি শহরকে ধ্বংসকরে
দেয়া যায়। পারমাণবিক অস্ত্রকে ধরা হয়
ব্যাপকধ্বংসযজ্ঞের এক বোমা হিসেবে।
পারমাণবিক অস্ত্রের গভীরে
১৯৫২ সালে হাঙ্গেরীয় রসায়ন বিজ্ঞানী
এডওয়ার্ড টেলর সর্বপ্রথম
হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করেন।
ফিশানের শাব্দিক অর্থ হলো বিভাজন। একটি
ভারী পরমাণুকে দ্রুতগামী নিউট্রন দ্বারা
ভেঙে হালকা ভরের একাধিক পরমাণু ও
শক্তি উৎপন্ন করার কৌশলই হলো ফিশান
বিক্রিয়া। জার্মান বিজ্ঞানী অটোহ্যান ও
স্ট্রেসম্যান এর মূল তত্ত্ব আবিষ্কার
করেন। পারমানবিক অস্ত্র সমূহের মধ্যে
ফিশানই বহুল পরিচিত। যে সকল তেজস্ক্রিয়
পদার্থ এই ফিশান ক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদের
ফিসাইল পদার্থ বা পারমানবিক বিক্রিয়ার জ্বালানী
বলা হয়; যেমন ইউরেনিয়াম ২৩৫
আইসোটোপ অথবা প্লুটোনিয়াম ২৩৯
আইসোটোপসমূহ। একটি দ্রুতগামী
নিউট্রন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম
পরমাণুকে আঘাত করে কিছু নতুন পরমাণু, দুটি
নিউট্রন ও প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়।
উৎপন্ন হওয়া পরমাণুগুলো আবার নতুন
পরমাণুকে আঘাত করে। এভাবে বিক্রিয়া
চলতে থাকে যতক্ষণ না জ্বালানী শেষ
হয়। তাই একে চেইন বিক্রিয়া বলা হয়। চেইন
বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ
আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরণ
(E = mc2)দ্বারা বের করা যায় যেখানেE
হচ্ছে উৎপন্ন শক্তি, m হচ্ছে ভর ও c
হলো শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ।
পারমানবিক অস্ত্র উৎপাদনের মূল
প্রতিবন্ধকতা হলো প্রকৃতিতে প্রাপ্ত
তেজস্ক্রিয় মৌলের স্বল্পতা। প্রকৃতিতে
ঠিক যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুদ তার ৯৯.২৯
শতাংশ হলো ইউরেনিয়াম-২৩৮
আইসোটোপযা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র
তৈরি সম্ভব নয় কারণ ইউরেনিয়াম-২৩৮
স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিউট্রন কণিকা নির্গমন
করে ভেঙ্গে যায়। তাই বাকি মাত্র ০.৭৯
শতাংশ ইউরেনিয়ামকে পৃথক করে বিশুদ্ধ
করতেই মূল বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ
খরচ হয়ে যায়। এই পৃথকীকরণের কাজে
যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম
সেন্ট্রিফিউজ।আবার এই যন্ত্র দিয়ে
ইউরেনিয়াম-২৩৮ কে প্লুটোনিয়াম-২৩৯
আইসোটোপে পরিণত করা সম্ভব যা
ফিসাইলযোগ্য। ২০% বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম-২৩৫
আইসোটোপকে বলা হয় হাইলি এনরিচড
ইউরেনিয়াম বা (HEU) এবং ৮০% বা তার অধিক
বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম -২৩৫ কে বলা হয় উইপন্স
গ্রেডেড ইউরেনিয়াম।
পারমাণবিক অস্ত্রের রেসিপি!
এখন প্রশ্ন থেকে যায়-একটি পারমাণবিক
অস্ত্র বানাতে কতটুকু ইউরেনিয়াম বা
প্লুটোনিয়াম লাগবে? প্রতিটি পারমাণবিক
অস্ত্র তৈরিতে সর্বনিম্ন যে পরিমাণ ফিসাইল
পদার্থের প্রয়োজন হয় তাকে সংকট ভর
বা ক্রিটিক্যাল মাস বলা হয়। অর্থাৎ এর কম
পরিমাণ ফিসাইল পদার্থ থাকলে নিউক্লিয়ার
চেইন বিক্রিয়া শুরু হয়না। এই সংকট ভর ফিসাইল
পদার্থের ঘনত্ব, আকৃতি, বিশুদ্ধতা এবং
পদার্থটিকে ঢেকে রাখার জন্য যে ধাতব
আবরণ বা শেল ব্যবহৃত হয় তার ওপর নির্ভর
করে। এখানে বলে রাখা ভালো, ফিসাইল
পদার্থ তেজস্ক্রিয় বলে তারা সর্বদা
স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিউট্রন কণিকা নিঃসরণ করে।
তাই জ্বালানীর বহিরাবরণটি যদি এমন পদার্থ
দিয়ে নির্মিত হয় যা উক্ত নিউট্রন
কণিকাসমূহকেকোনো উপায়ে প্রতিফলিত
করতে পারেতবে জ্বালানীতে নিউট্রন
কণিকার ঘনত্ব বেড়ে যাবে ফলে
নিউট্রনের সাথে পরমাণুর সংঘর্ষের প্রবণতা
বৃদ্ধি পাবে। তাই এই বহিরাবরণকে
রিফ্লেক্টর টেম্পার বলে যা বেরিলিয়াম
ধাতুর তৈরি।
সংকট ভরের চেয়ে কম পরিমাণ ফিসাইল
পদার্থকে সাব ক্রিটিক্যাল মাস এবং সংকট
ভরের চেয়ে বেশী পরিমাণ ফিসাইল
পদার্থকে সুপার ক্রিটিক্যাল মাস বলে। বিশুদ্ধ
ইউরেনিয়ামের সংকট ভর ৫৬ কিলোগ্রাম ও
প্লুটোনিয়ামের এর তুলনায় বেশ কম(মাত্র
১০ কিলোগ্রাম)। অর্থাৎএকটি পারমাণবিক
অস্ত্র তৈরি করতে কমপক্ষে ৫৬
কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম অথবা ১০
কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম লাগবে। এখন
অবশ্য মাত্র ৫ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম
দিয়ে স্যুটকেইস আকারের পারমাণবিক
বোমা প্রস্তুত করা সম্ভব। কিন্তু
এক্ষেত্রে প্লুটোনিয়ামের বিশুদ্ধতা
অত্যন্ত বেশি।
নির্মাণ কৌশলের দিক দিয়ে ফিশান পারমাণবিক
অস্ত্র দু’প্রকার-গান টাইপ ও ইমপ্লোসন
টাইপ। গান টাইপ পারমাণবিক অস্ত্রের
কার্যপ্রণালী খুবই সহজ সরল কিন্তু দক্ষতা
খুবই কম(মাত্র ১.৪ শতাংশ)। অপরদিকে
ইমপ্লোশন টাইপের দক্ষতা ২০ শতাংশের
কাছাকাছি।
গান-টাইপ পারমানবিক অস্ত্রের নির্মাণশৈলী
অনেকটা বন্দুকের মতোতাই এর নাম গান
টাইপ। একটি লম্বা টিউবযার গায়ে বেরিলিয়াম
মৌলের প্রলেপ লাগানো থাকে। এর
দু’প্রান্তে সংকট ভরের চেয়ে কম
অর্থাৎ সাব ক্রিটিক্যাল মাসের ফিসাইল পদার্থ
ইউরেনিয়াম-২৩৫ রাখা হয়। এক প্রান্তে
ইউরেনিয়ামের তৈরি বুলেট ও অপর
প্রান্তে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ
ইউরেনিয়াম-২৩৫ জমা থাকেযাকে বলে
টার্গেট। এরপর টিউবের ভেতর সাধারণ বারুদ
(কনভেনশনাল এক্সপ্লোসিভ) দিয়ে
ইউরেনিয়াম বুলেটকে গতিশীল করা হয়
এবং তা অপরপার্শ্বে রক্ষিত টার্গেট
ইউরেনিয়ামের সাথে প্রবল বেগে ধাক্কা
খায়। সংঘর্ষের পর এরা পরস্পর মিলিত হয়ে
সুপার ক্রিটিক্যাল মাস তৈরি করে এবং ফিসাইল
পদার্থ থেকে নিঃসৃত নিউট্রন কণিকা টেম্পার
রিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত হয়ে উক্ত
ইউরেনিয়াম জ্বালানীকেই আঘাত করে।
এভাবেই শুরু হয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া যার
ফলশ্রুতিতে ঘটে পারমাণবিক বিস্ফোরণ।
ব্যাস! তৈরি হয়ে গেল গান টাইপ পারমাণবিক
অস্ত্র। জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষেপিত
‘লিটল বয়’ছিলো এই ধরনের অস্ত্র যার
শক্তিমাত্রা ছিলো ১৫ কিলোটন টি.এন.টি এবং
তাতে ৬৪.১ কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম
ব্যবহৃত হয়েছিলো। এ পদ্ধতি সহজ হলেও
এর জ্বালানি তথা ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম
খুব বিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন যা কিনা বহুল
ব্যায়সাধ্য।এছাড়া পূর্বেই বলা হয়েছে গান
টাইপের দক্ষতা খুবই কম ও নির্ভরযোগ্য
নয়। তাই গান টাইপের চেয়ে
ইমপ্লোশনটাইপ আরও অনেক বেশি
কার্যকরকিন্তু এর গঠন প্রণালী বেশ জটিল।
ইমপ্লোসন টাইপে জ্বালানী হিসেবে
‘পিট’ব্যবহৃত হয় যা কিনা লঘু ঘনত্বের ফিসাইল
পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পিট বিষাক্ত ও
ক্ষয়িষ্ণু হওয়ায় পিটের চারপাশে নিষ্ক্রিয়
ধাতুর (যেমন- স্বর্ণ ) পাতলা আবরণ দেয়া
হয়যা গোলাকার। স্বর্ণের পাতলা
আবরণযুক্ত পিটকে বেরিলিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম
এর সংকর ধাতু দ্বারা মুড়িয়ে রাখা হয় যা কিনা
ফিসাইল পদার্থ থেকে নিঃসৃত নিউট্রন কণিকার
প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে।আগেই বলা
হয়েছে যে এর নাম টেম্পার
রিফ্লেক্টর। এবার সম্পূর্ণ ডিভাইসটিকে
কারডাইট বিস্ফোরক বা বারুদের মাঝে রাখা
হয়। বহিঃস্তরের কার্ডাইট বিস্ফোরিত হয়ে
শক ওয়েভ সৃষ্টি করে যা ভেতরে রাখা
অল্প ঘনত্বের পিটকে সংকুচিত করে
ফেলে ও এর ঘনত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে
দেয়। এর ফলে জ্বালানী সুপার ক্রিটিক্যাল
মাসে উপনীত হয় এবং জ্বালানী থেকে
নিঃসৃত ও টেম্পার রিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত
হওয়া নিউট্রন কণিকার আঘাতে নিউক্লিয়ার
চেইন বিক্রিয়া শুরু হয়। যদি পিটের ভেতর
অল্প পরিমাণে হাইড্রোজেনের
আইসোটোপ (ডিউটেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম)
ঢুকিয়ে দেয়া হয়তবে নিউট্রন কণিকা
নিঃসরণের মাত্রা বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং
অধিক ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়, একে
‘বুস্টিং’বলে। ইমপ্লোসন টাইপ পারমাণবিক
অস্ত্রে‘হাই এনরিচড ইউরেনিয়াম’জ্বালানী
হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে স্বল্প
পরিশোধিত ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম দ্বারা
এ ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত সম্ভব।
আর এ কারণেই ইমপ্লোসন টাইপ পারমাণবিক
অস্ত্র বেশি জনপ্রিয়! জাপানের নাগাসাকিতে
নিক্ষেপিত‘ফ্যাট ম্যান’এ ধরণের পারমাণবিক
অস্ত্র ছিলো।
একবার আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা
হয়েছিলো,“তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী
ধরণের অস্ত্র ব্যবহার হতে
পারে?”আইনস্টাইনের উত্তর
ছিলো,“তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না,
তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর
দিয়ে হবে তা বলতে পারি।”
প্রজেক্ট ম্যানহাটন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (‘কালীন’ এবং ‘সময়’
একইরকম হয়ে যাচ্ছে) সময় সকল দেশই
পারমাণবিক বোমার দিকে এগোচ্ছিলো।
যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে ব্রিটেনের তখন
ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। জার্মানি ইউরেনিয়াম ফিসন
গবেষণায় এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধকালীন
সময়ে এ দিকে তাদের নজর ছিল না।
রাশিয়াকে পারমাণবিক বোমার জন্য অপেক্ষা
করতে হয় ১৯৪৯ সাল অবধি। যুদ্ধের
কারণে জাপানে তখন ঘাটতি চলছে।
তাদেরও পারমাণবিক গবেষণার টাকা তখন
নেই। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ
যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে গেলো পারমাণবিক
বোমার দিকে। ১৯৩৯ সাল থেকে শুরু
করে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ২০০
কোটি ডলারেরও বেশী খরচ
করে‘ম্যানহাট্ন প্রজেক্ট’-এ প্রথম
পারমাণবিক বোমাটি তৈরি করা হয়আর এর প্রধান
ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার।
ম্যানহাট্ন প্রজেক্টে কর্মরত
উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীরা ছিলেন-
রবার্ট ওপেনহাইমার ( Robert
Oppenheimer),ডেভিড বম(David
Bohm),লিও শিলার্ড (Leo Szilard),ইউজিন
উইগনার (Eugene Wigner), অটো ফ্রিশ
(Otto Frisch),রুডলফ পিয়ারলস (Rudolf
Peierls), ফেলিক্স ব্লক (Felix
Bloch),নেইল বোর(Niels Bohr),এমিলিও
সেগর (Emilio Segre), জেমস ফ্রাঙ্ক
(James Franck),এনরিকো ফার্মি (Enrico
Fermi), ক্লাউস ফুক্স (Klaus Fuchs) এবং
এডোয়ার্ড টেলার (Edward Teller)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন
আগে ১৯৩৯ সালের ২রা আগস্ট
পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইন আমেরিকান
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি
লিখলেন। সেই চিঠিতে তিনি
ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধকরণেজার্মানির
অগ্রগতি সম্পর্কে আমেরিকার
প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে দেন এবং
তাকে পারমাণবিক বোমতৈরির উদ্যোগ
নিতে বলেন।
১৯৩০ এর দশকে ইউরোপ থেকে
পালিয়ে আসা বিজ্ঞানীদের মাঝে ছিলেন
হাঙ্গেরীয় লিও শিলার্ড,এডওয়ার্ড
টেলারএবং ইউজিন উইগনার। তারা চাইতেন
পারমাণবিক বোমতৈরিতে আমেরিকান
প্রশাসনউদ্যোগ নেওয়া শুরু করুক। কিন্তু
তাদের তেমন রাজনৈতিক প্রভাব ছিলো না।
তারা আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হলেন।
আইনস্টাইনের স্বাক্ষরযুক্ত চিঠি ব্যক্তিগত
বন্ধু আলেক্সান্ডার স্যাকস এর হাত ঘুরে
প্রেসিডেন্টের হাতে পৌছালো প্রায়
দু’মাস পর, ১৯৩৯ সালের ১১ই অক্টোবর।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সেনা এবং
নৌবাহিনীর প্রতিনিধি সমন্বয়ে ইউরেনিয়াম
গবেষণার জন্য কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানান
পদার্থবিজ্ঞানীদের। লিম্যান জে
ব্রিগসের (Lyman J. Briggs)নেতৃত্বে
গঠিতব্রিগস ইউরেনিয়াম কমিটিপ্রথম বৈঠকে
বসলো ১৯৩৯ সালের ২১শে অক্টোবর।
সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে
গঠিত ইউরেনিয়াম কমিটি তাদের ১৯৪০ সালের
গোঁড়ার দিকের প্রতিবেদনে
আইসোটোপ নিষ্কাশনে এবং চেইন
রিঅ্যাকশন গবেষণায়অপর্যাপ্ত অর্থের
সীমাবদ্ধতারউল্লেখ করেন।
পরমাণু বোমা তৈরিতে সবচেয়েগুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপার হলো যথেষ্টপরিমাণ ইউরেনিয়াম
পাওয়া। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের আকরিকে
ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় খুবই অল্প পরিমাণে,
৫০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ। যতটুকু
ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় তাতে মিশ্রিত থাকে
ইউরেনিয়াম ২৩৫ এবং ২৩৮, এর মাঝে শতকরা
৯৯ ভাগের বেশী হলোইউরেনিয়াম-২৩৮
যা সহজে ভাঙা যায় না অর্থাৎ তা ফিশনযোগ্য
নয়। আবার ইউরেনিয়াম-২৩৮ এবং
ইউরেনিয়াম-২৩৫ আলাদা করাও খুব সহজ
নয়কারণ দুটি আইসোটোপেরই রাসায়নিক
ধর্ম এক এবং তাদের মধ্যে পরমাণুর ভরের
পার্থক্য মাত্র ১%।এই যে ১% পার্থক্য- এর
উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন
বিজ্ঞানীরা।
১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনে
কর্মরত দুই স্বপক্ষত্যাগী জার্মান
বিজ্ঞানী Otto Frisch এবং Rudolf Peierls
ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ফিশনের মাধ্যমে
পারমাণবিক বোমা তৈরির দিক নির্দেশনা দেন।
তাদের রূপরেখাকে ভিত্তি করেই ১০ই
এপ্রিল গঠিত হলো সাংকেতিক নামের
MAUD Committee। এই কমিটি ইউরেনিয়াম
সমৃদ্ধকরণের জন্য Gaseous Diffusion
পদ্ধতিকে বেছে নিয়ে ১৯৪১ সালে
পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্পের কারিগরি
দিক সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট দিলো।
১৯৪১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পারমাণবিক
বোমতৈরির জন্য Arthur H. Compton-এর
নেতৃত্বে সাংকেতিক নামের S-1 প্রকল্প
হাতে নেওয়া হলো আমেরিকাতে। ১৯৪২
সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া
হলো পারমাণবিক বোমার জন্য গোপন
প্রকল্প Metallurgical Laboratory (Met
Lab)। এনরিকো ফার্মি এখানেই নকশা
করলেন গ্রাফাইট এবং ইউরেনিয়াম ব্যবহার
করে প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর CP-1 এর।
১৯৪২ সালের ১৮ই আগস্ট সেনাবাহিনীর
ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে কর্নেল মার্শালের
অধীনে স্থাপন করা হলো পারমাণবিক
বোমতৈরির ছদ্মনামের প্রকল্প ‘ম্যানহাট্ন
ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট’যা পরবর্তীতে রূপ
নেয় সাফল্যজনকভাবে পারমাণবিক
বোমতৈরির সমন্বিত পরিকল্পনা‘ম্যানহাট্ন
প্রজেক্ট(Manhattan Project)’হিসেবে।
আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রকৃত
কাজ শুরু হলো লেসলী রিচার্ড
গ্রোভের নেতৃত্বে ১৯৪২ সালের
সেপ্টেম্বর মাসে। গ্রোভ ছিলেন
একজন দক্ষ সংগঠক। পারমাণবিক বোমার
জন্য যথেষ্টপরিমাণ ইউরেনিয়াম জোগাড়
করলেন গ্রোভ। পারমাণবিক বোমতৈরির
ফ্যাক্টরী স্থাপনের জন্য নিয়োগ
করলেন শিল্প কোম্পানি ডুপোন্ট এবং
কেলগ কর্পোরেশনকে। নিউ
মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের লস আলামস-এ
অস্ত্র পদার্থবিজ্ঞান, নকশা এবং গবেষণার
জন্য স্থাপিত হলো Project Y।
ওপেনহাইমার এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ
পেলেন। তিনি ছিলেন
ক্যালিফোর্নিয়াবিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার
অধ্যাপক। ফার্মি তার নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর
CP-1 এ ইউরেনিয়াম এবং গ্রাফাইট ব্যবহার
করে ১৯৪২ সালের ২রা ডিসেম্বর প্রথম
উৎপাদন করলেন পারমাণবিক শক্তি। জানুয়ারী
১৯৪৩ এ গ্রোভওয়াশিংটনে প্রতিষ্ঠা
করলেন প্লুটোনিয়াম গবেষণা এবং উৎপাদন
কারখানা। মার্চ মাসে পুরোদমে কাজ শুরু
হলো লস আলামস-এ । ঐ সময়েই
যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক বোমা
ব্যবহারের জন্য বিমানের প্রস্তুতি,
বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ এবং বিমান ক্ষেত্র
প্রস্তুতের জন্য গ্রহণ করা হলো অপর
একটি প্রজেক্ট যার নাম ‘প্রোজেক্ট
আলবার্টা’।
১৯৪৪ সালে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে কাজ
শুরু হলো- ১) যথেষ্টপরিমাণ ফিশনযোগ্য
ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়ামের উৎপাদন,
২) পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং ৩) বোমাকে
বয়ে নিয়ে গিয়ে শত্রুর উপর নিক্ষেপ।
এই বছরের ১লা জুলাই ম্যানহাট্ন
প্রজেক্টকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রকল্প
হিসেবে (AA-1) চিহ্নিত করা হলো।
লেসলী গ্রোভ আগস্ট মাসে পারমাণবিক
বোমার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করলেন
১৯৪৫ সালের বসন্তের মাঝামাঝি। এই সময়ে
১৭ টি বি-২৯ বোমারু বিমানকে পরমাণু বোমা
ফেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা
শুরু হলো।একই বছরের সেপ্টেম্বরে
ফার্মির তত্ত্বাবধানে শুরু
হলোপুরোদমেপ্লুটোনিয়াম উৎপাদনের
কাজ। অক্টোবরে ওপেনহাইমার
আলমোগর্ডোতে প্রথম পরমাণু বোমা
বিস্ফোরণের পরীক্ষার প্রস্তাব
অনুমোদন করলেন।
১৯৪৫ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি জুড়ে
চললো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং
প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের কাজ।এই বছরের
এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট
মস্তিষ্কেরক্তক্ষরণে মারা গেলে
ট্রুম্যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে ম্যানহাটন
প্রজেক্টের অগ্রগতি এবং পারমাণবিক
বোমার তৈরি সম্পন্ন হওয়ার কথা জানালেন
যুদ্ধ সচিব হেনরি স্টিমসন এবং জেনারেল
গ্রোভ।
নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসে
Jornada del Muerto(The journey of
Death) পাহাড়ের পাদদেশ নির্ধারণ করা
হলো পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম পরমাণু
বোমা বিস্ফোরণের স্থান এবং ১৬ই জুলাই
সম্ভাব্য দিন হিসেবে। স্থানের
সাংকেতিকনাম হলো ট্রিনিটি (Trinity) এবং
প্রথম পারমানবিক বোমা হলোগেজেট
(Gadget)।
১৪/১৫ জুলাই ১০০ ফুট উঁচু ইস্পাতের
টাওয়ারের উপর পরমাণু বোমা স্থাপনের
কাজ চললো। ১৬ই জুলাই ভোর ৫টা ২৯মিনিট
৪৫ সেকেন্ডে ইতিহাসের প্রথম পরমাণু
বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। এই
বোমার ধ্বংস ক্ষমতা ছিলো ২০-২২
কিলোটন টি,এন,টি’র সমান। বাষ্পীভূত হয়ে
গেলো ইস্পাতের টাওয়ার। আশেপাশের
মাটি পুড়ে কাঁচের তৈরি আস্তরণে ঢাকা
পড়লো।বিষ্ফোরণের অগ্নিশিখা এত
উজ্জ্বল ছিলো যে সেই আলো
দেখে দূর-দূরান্তের বাসিন্দারা ভুল করলো
সেদিন- সূর্য কি দুই বার উঠলো? ১২০ মাইল
দুরের অন্ধ এক বালিকাও সেদিন টের
পেয়েছিল সেই আলো! মুহূর্তের
মধ্যে কমলা রঙের আলোর কুণ্ডলীর
মেঘ সেকেন্ডে ৩৬০ ফুট বেগে
উঠে গেল ৩০,০০০ ফুট উঁচুতে!
এই দৈত্য, পারমাণবিক বোমাকে ব্যবহার না
করার আবেদন জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু তাদের সেই কথায় কর্ণপাত করেনি
কেউ।
এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো
বিজ্ঞানীদের মাঝে। ইসিডর রাবি (Isidor
Rabi) প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন,“প্রকৃতির
সমস্ত নিয়ম আজ উল্টেগেলো, মানুষ
আজ থেকে পৃথিবী ধ্বংসের বিধাতা
হলো”।ওপেনহাইমার গীতার শ্লোক
উদ্ধৃতি দিলেন,“আমি নিজে এখন মৃত্যুরূপে
আবির্ভূত হলাম”। এই পরীক্ষার পরিচালক
কেন বেইনব্রিজওপেনহাইমারকে
বললেন “Now we’re all sons of bitches.”
যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত
ম্যানহাটন প্রজেক্টের সব কাগজ পত্র
সরিয়ে ফেলে। শুনে অবাক হবেন যে
এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত কোনো
ব্যাক্তিরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি,হয়তো কেউ
খুন হয়েছেন নতুবা আত্মহত্যা করেছেন!
পারমাণবিক অস্ত্রের সাইড এফেক্ট
এবার একটু অন্যদিকে নজর দেয়া যাক।
আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে
পৃথিবীতে কোনো এক সময় এলিয়েন
এসেছিল এবং তাদেরই কথা প্রাচীন
গ্রন্থগুলোতে ফুটে উঠেছে। যেমন
মহাভারতে আছে, পৃথিবীর উপর লোহা ও
পাথরের তৈরি তিনটি ভাসমান নগরী ছিলো।
এগুলোই কি এলিয়েন স্পেসশীপ?
সেগুলো থেকে দেবতারা বিমানে
(সংস্কৃতে বিমান শব্দের অর্থ ভাসমান বস্তু)
করে মাটিতে নামতেন। এগুলো কি ফ্লাইং
সসার?দেবতাদের যুদ্ধের সময় বিভিন্ন
ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করা হতো যেগুলো
মাটিতে পড়লে হাজারটা সূর্যের মতো
আলো জ্বলে উঠতো। যারা দেখতো
তাদের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতো, কারো
চুল পড়ে যেতো, পুরুষরা প্রজনন ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলতো। সেই প্রভাব পরবর্তী
১০০ বছর পর্যন্ত থাকতো। পারমাণবিক
বোমার পরবর্তী শারীরিক প্রভাবের
সাথে এই বর্ণনা একেবারেই মিলে যায়।
এসব ঘেঁটে অনেকেই মনে করেন
যে পারমাণবিক বোমার জনক
ওপেনহাইমারের সাথে এলিয়েনদের
সরাসরি যোগাযোগ ছিলো। শুনতে
হাস্যকর মনে হলেও আমেরিকার
অনেকেই এটি বিশ্বাস করেন।
আমরাঅনেককিছুই জানলাম। বিজ্ঞানের
পাশাপাশি ইতিহাস নিয়েও বেশ নাড়াচাড়া হলো।
এখন প্রশ্ন হলো যেসব দেশে
ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম মজুদ আছে
অথবা যেসব দেশে পারমাণবিক শক্তিকে
কাজে লাগিয়ে নানা শক্তিতে রূপান্তরিত করা
হচ্ছে সেসব দেশ চাইলেই কি পারমাণবিক
বোমা বানাতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে
আরেকটু ইতিহাস ঘেঁটে আসা যাক- কিভাবে
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ পারমাণবিক
শক্তিধর একটি রাষ্ট্রে পরিণত হলো।
ভারত মূলত তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু
করে ১৯৪৪ সালে। ভারতীয় পরমাণু
বিজ্ঞানী হমি ভাভা প্রতিষ্ঠা করেন টাটা
ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ। সেখান
থেকেই পরমাণু গবেষণা শুরু করে ভারত।
পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতার পর হমি
ভাভার তত্ত্বাবধানে পারমাণবিক কর্মসূচির
আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন তখনকার
প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু।
তবে ১৯৫৪ সালের দিকে ভাভা তার কর্মসূচি
অস্ত্র বানানোর দিকে নিয়ে যান। তখন
থেকেই সত্যিকার অর্থে ভারত তাদের
পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে।
ষাটের দশকে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র
কর্মসূচি ধীর গতিতে এগোতে থাকে।
তবে ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে
হেরে যাওয়ার পর নেহরু পারমাণবিক অস্ত্র
তৈরির প্রতি আরও আগ্রহী হন। ১৯৬৫ সালে
ভাভার নেতৃত্বে পারমাণবিক অস্ত্রের
ডিজাইন তৈরি করা হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি মারা
গেলে তাকে ভারতীয় পরমাণু
কর্মসূচীর জনক উপাধি দেওয়া হয়। পরে
তার স্থলাভিষিক্ত হন বিজ্ঞানী আর রামান্না।
বেশীরভাগ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে
ইউরেনিয়াম ব্যাবহার হলেও ভারত ব্যবহার
করে প্লুটোনিয়াম। রাশিয়ার এক
প্লুটোনিয়াম রিঅ্যাকটর দেখেই মূলত এই
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে পূর্ণিমা
নামে একটি গোপন প্লুটোনিয়াম প্লান্ট
তৈরি করা হয়। এখান থেকেই মূলত পারমাণবিক
অস্ত্রের জন্য প্লুটোনিয়াম সরবরাহ করা
হতো।
১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী পারমাণবিক অস্ত্র
পরীক্ষার জন্য অনুমোদন দেন। তার এই
অনুমোদনের ব্যাপারে খুব কম মানুষই
জানতো। এমনকি তখনকার প্রতিরক্ষা
মন্ত্রী নিজে জানতে পেরেছেন
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার পরে!
১৯৭৪ সালের ১৮ই মে বুদ্ধ জয়ন্তীতে
রাজস্থান রাজ্যের পোখরানে ভারতীয়
সামরিক ঘাঁটিতে প্রথম পারমাণবিক বোমার
বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অপারেশনের নাম
ছিলো ‘পোখরান ১’ বা ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’।
এই পোখরান বিস্ফোরণের মাধ্যমে
ভারতই প্রথম রাষ্ট্রে পরিণত হল যারা কিনা
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য না
হয়েও পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশেও ইউরেনিয়ামের সন্ধান
মিলেছে। খুব শীঘ্রই রাশিয়ার
সহযোগীতায় আমাদের দেশে চালু
হতে যাচ্ছে দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
দেশের টিএসসির মোড়েই রয়েছে
বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন। কিন্তু
পারমাণবিক শক্তিধর হতে যে পরিমাণ
গবেষণা এবং খরচাদির দরকার সেটা
বাংলাদেশের মতো একটি দেশের বহন
করা খুবই কষ্টকর। আমাদের পার্শ্ববর্তী
দেশ ভারত, পাকিস্থান, চীনের কাছে
পরিমাণ মজুদ রয়েছে এই পারমাণবিক বোমা।
তাদের ভেতর রাজনৈতিক অবস্থাও যে খুব
স্বাভাবিক তাও নয়। তবে আগামী ভবিষ্যতে
যদি তারা নিজেদের মাঝে পারমাণবিক শক্তি
প্রদর্শন করে তবে সেটার ফলাফল
আমাদের দেশকে কিছুটা হলেও ভোগ
করতে হবে।
স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকেই মূলত
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু
হয়েছিলো বৃহৎ শক্তিবর্গের মাঝে।
কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তীতেও কিছু
যুদ্ধোন্মাদ নেতারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার
খোঁড়া অজুহাত তুলে শত কোটি টাকা
অপচয় করে একের পর এক পারমাণবিক
যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে বিশ্বশান্তিকে চরম
হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। যারা
ইসরায়েলএর আগ্রাসী পারমাণবিক
প্রকল্পের কথা জেনেও চোখ বন্ধ
করে রাখে কিন্তু ইরানের শান্তিপূর্ণ
পারমাণবিক প্রকল্পে বাধা দেয় ও মিথ্যা
অজুহাত তুলে বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে,
তারাই এখন বিশ্বে এককভাবে পারমাণবিক
যুদ্ধাস্ত্রের মালিক এবং গোটা বিশ্বের
নিয়তি এসব অর্ধোন্মাদ নেতাদের হাতের
মুঠোয়। তাই এখন থেকেই আমরা
সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের
এই প্রিয় সবুজ পৃথিবী একদিন ঊষর, বন্ধ্যা ও
তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ এক নির্জীব
গ্রহে পরিণত হবেযেখানে থাকবেনা
কোনো প্রাণের স্পন্দন।
মানুষ আর সেই হিরোশিমা নাগাসাকির মতো
ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না। তারা শান্তিতে বাঁচতে
চায়। তাই আমাদের সবার দাবি এটাই যে সকল
সক্রিয় পারমানবিক বোমাকে নিষ্ক্রিয় করে
প্রত্যেকটি দেশ পারমাণবিক বোমা উৎপাদন
থেকে বিরত থাকুক এবং বিজ্ঞানের এই
সুন্দর আবিষ্কারকে মানুষের ধসের কাজে
ব্যবহার না করে তাদের উপকারে ব্যবহার
করুক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন